Monday, October 23, 2017

কল্পনার শরীর থেকে হাড়ে



টিনেরছাদেএকফোঁটাওবৃষ্টিহয়নি
সবটাইভিজেছিপছিপেহয়েগেছে, রুক্ষতাঃ
আরতোমারপবিত্রবিছানারমতশরীর!

বুলেটেরস্রোতেরমততড়িৎগতিতে
প্রস্তানেরমতচকচকেরক্তপাতে;
বিন্দুমাত্রনিহিতহয়নিকলঙ্কিতরাত
কল্পনারগভীরে, কল্পনারশরীরথেকেহাড়ে
তারপরআরওএকটাকল্পনাবেঁয়েজীবনান্তে
পদ্মারহাওয়ানিয়েআসেশেষসূর্যাস্ত! 

জীবন! সংস্কারমুক্তকংক্রিটেরকারবালায়
মরুভূমিরতারকাখসেপড়ারআগুনে- উত্তপ্তহয়
এবংশীতলহৃদয়েআগস্টচাঁদেরউষ্ণতাতে,
গলেপড়েঅতীতপ্রিয়মানচিত্র!

রুক্ষ, চূর্ণ, অপূর্ণগোলকধাঁধারবাস্তসংস্থানে
তুষারসাদাতৃতীয়বিশ্বযুদ্ধকালীনসময়ে
বাংলাদেশিসিরাজউদ্দোলামনঃক্ষুণ্ণহয়নি
নৈঃশব্দ্যেরমতমর্মভেদীঅস্ত্রঘাত, প্রতিঘাত
বিশ্বাসেরমতবিশ্বাসঘাতকসুখেরবুলড্রেজারে
ছিন্নভিন্নমরুরমাটিআরআমারমতনভোমণ্ডলীরমৃততারকা!

পচনশীলযোদ্ধারআক্রোশে
বুলেটেরক্রোধেরমতউল্লাসে
আরওএকটাসমূহজীবনদাঁড়াতেপারে, দাঁড়ায়-
সৌধস্থলেসুমহৎস্মৃতিরবিচ্ছেদবিশিষ্টমননিয়ে,
নরকেরউপকূলেযুদ্ধেরজন্যদাঁড়িয়েথাকে,
ব্যক্তিগতবিবেক! এখনএখানেএভাবেই
সমুদ্রেরজল; তোলেআঁখি!

তারপররোজকারমতফিরেআসেসচ্ছরাত্রি
শীতেরঝরাপাতা, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ারনীরবতা
কর্দমাক্তজুতারতলায়বিষণ্ণকবরখানা
আরনেশাগ্রস্থকার্তিকেরঅমৃতরক্তপাত! 

এরপর- তুমিদাঁড়িয়েযাও, বিদায়নাও
সমস্তরক্তাধ্যায়আফিমেরসুগন্ধেমেলে
বিদ্রোহআররক্তক্ষরণেরজন্য
প্রসন্নআরপ্রাচুর্যেভরাদেহেরজন্য
যেনএইমাত্রতুমিধর্ষিতহলে
২৫শেমার্চেরভয়াবহতানিয়ে
অথচ, তোমারআত্মত্যাগেএকটিদেশজন্মনিতো!

কিন্তুতুমিতানও, তোমারবাড়িটাতে
গোলাপ, বেলি, টিউলিপফুলেরবাসস্থান
চারিদিকেপবিত্রারসৌন্দর্যে
এতটাইবিষধরআরএতটাইবিষাক্তযে,
যাপাহারাদেয়দুটিকার্তিকেয়কুকুর
আরআমিঅপবিত্রঃসেখানেকখনোইপ্রবেশকরতেপারিনা!

Sunday, May 7, 2017

নেশাগ্রস্থ কার্তিকের অমৃত রক্তপাত!



ভাল যাওয়া সময়ের মধ্যে অন্যতম অমৃত ছিল। বৃষ্টি আর বিষণ্ণতার যোগসূত্রে এক উজ্জ্বল বৈরী সকালে আমি আর আমার প্রাণপ্রিয় শত্রু বেরিয়েছিলাম শহরটা ঘুরবো বলে। কিন্তু কিছু সময় অতিবাহিত করার পর আমাদের দুজনের মনে হল- এমন কোথায় যাই যেখানে একশ বছর কেউ যাইনি। আর এমন জায়গার কথা ভাবতেই আমার শহরের পুরনো গোরস্থানের কথা তাকে বললাম। আজও আবিষ্কার করতে পারিনি প্রথম বলাতেই সে সেদিন কিভাবে হ্যাঁ বলেছিল? সেটা রোমাঞ্চতার বশে, এ্যাডভেঞ্জারের বশে নাকি তার মনে অন্যকিছু ছিল? অবশ্য আমাদের ভেতর অদ্ভুত সব কাজ করার মন-মানসিকতা দুটোই শয়তানীয়ভাবে ছিল।

আমরা যেখানে বসে চা-এর সাথে কথা খাচ্ছিলাম সেখান থেকে গোরস্থানের দূরত্ব এক থেকে ঢেড় কিলোমিটার হবে। বলে রাখি- সেদিন রাতে বৃষ্টি হয়েছিল আর দিনটা ছিল মেঘলা বিষণ্ণ। আমরা যখন ওখানে পৌঁছালাম তখনও সে বেশ হাসিখুশি। যদিও চারিদিকটা ভূতের আড্ডাখানা মনে হচ্ছিল। আর মনে না হবারও কোন উপায় নেই। কারণ জানেনই তো- গোরস্থানে যতসব ভাল-মন্দ-পবিত্র ভূতের সরাইখানা। প্রায় ৬ একর এলাকা সেকেলে ইটের গাঁথুনি আর লোহার গ্রীল দিয়ে ঘেরা। কোন কোন অংশ একেবারে ভেঙে গেছে, লোহার গ্রীলে মরিচা পড়ে একদম প্রত্ন-নিদর্শন, ঠিক লোহা না মাটির দলা বোঝা যায় না। ঘন জঙ্গল আর আগন্তুক এমনকি মৃতদের শাস্তি দেওয়ার জন্য সাপ, বিছে তো আছেই। জায়গাটা একেবারেই পরিত্যক্ত অনেক বছর। পরিত্যক্ত সে কারণেই এখানে মানুষ প্রবেশ করে বলে শোনা যায় না। প্রবেশ না করার কারণ হল- এখানকার আসল বাসিন্দা মানে যারা হাশরে প্রথম কাতারে আমার সাথে মিলিত হবার জন্য আগেই চুড়ুইং করে মাটির কফিনে আশ্রয় নিয়েছে  (তারা লোভী বুঝলেন, লোভী) তাদের আত্মীয়-অনাত্মীয়রাও বহুযুগ আগে টপাং করে পরপারে জান্নাত-জাহান্নাম দেখছে! তাই তাদের আত্মার মাগফেরাত করার জন্য একটা কানা-কুঁজো লোকও বেঁচে নেই, আমি ছাড়া! আরও একটা কারণ হল- লোকমুখে অনেক ভয়ংকর আর রসালো খিচুড়ী গল্প শুনেছি যা শুনলে আপনিও বলবেন- আমায় অ্যামেরিকান সিটিজেন প্রাপ্ত পরমাত্মা রুমডেট দেওয়ার জন্য ভিসা পাঠিয়েছে! এই গোরস্থানে ইয়াবড় সাপ (এটা ঠিক কতবড় বলতে বোঝায় জানিনা, দুঃখিত) ইয়াবড় ভূত আছে বিটিভির দুই মাসের দু’ ইত্যাদি। অনেক দিন পর দুজনে বের হয়েছি একসাথে। আমাদের কোথায় আনন্দ নিয়ে একটু বেড়ানো উচিৎ, দুজনের একটু একান্ত সময় উপভোগ করা উচিৎ। সেখানে আমরা নাকি গোরস্থানে এলাম! গোরস্থানে তারাই আসে, যারা নারী-পুুরুষ থেকে লাশ হয়ে যায়। আমার মনে হয়- পবিত্র অন্ধাকারের জায়গায় মানুষের প্রবেশ করা উচিৎ নয়। এতে মৃতদের কষ্ট হয়। যেমন- আমার প্রাণপ্রিয় শত্রু সে তো একজন সম্পূর্ণ নারীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সদ্য যুবতী। গত রাতে ঋতুবতী হয়েছে। শরীয়ত মোতাবেক তার গোরস্থানে ঢোকা যাবে না। কিন্তু এসেছি তো আজ একশ বছর যেখানে জীবিত, মৃত মানুষের পা পড়েনি সেখানে দুজনে পা ফেলবো বলে। সাধারণত তার ভয় করার কথা অথবা ‘‘এ্যাঁই যাবনা গো’’ বলার কথা কিন্তু সত্যি বলতে কি সেসব থেকে নিরাশ থাকতে হল। সে আমার থেকে সামনে সামনে এগিয়ে গেল। আমি ‘পিছে গেলে সোনা পাই’ ভাবতে থাকলাম। ছেলেবেলা থেকে সবকিছুতে মানিয়ে নেওয়ার এক মহাগুন আমার মা আমায় দিয়েছিল সে কোন এক প্রাচীন পদ্ধতিতে। বলতো- হাটতে জানতে না তুমি, এখন হাঁটা শিখে গেছো। মানিয়ে নিয়েছো কিভাবে পৃথিবীর বুকের উপরে দাপড়িয়ে চলতে হয়। সেই থেকে তাই আমাকে বলতে পারেন সাদা বই-এর পাতা। আপনি চাইলেই আমাকে চোখ বন্ধ করে পড়তে পারেন! অনেক বার পড়তে চেয়েছি জঘন্ন যন্ত্রণাদায়ক সঙ্গীটাকে কিন্তু বুকের সাদা চামড়া দেখেও কখনো পড়তে পারিনি, বুঝতে পারিনি তার চামড়ার ভিতরে আছে কি? একপা দুপা করে গোরস্থানের ভেতরে চলে এলাম। আসার পথে প্রশান্তি বাতাস এসে বারবার কি যেন বলছিল ঠিক বুছতে পারিনি আমার প্রাণপ্রিয় শত্রুর হাসির জন্য। অদ্ভুত ভাল লাগছিল। যেন আদম-হাওয়ার সেই স্বর্গের প্রশেদ্বার দিয়ে ঢুকছি যেটা তারা আর খুঁজে পাইনি বলে বিলাপ করেছিল! দুজনে প্রাচীন সব কবর দেখছিলাম আর স্মৃতিস্তম্ভ গুলো পড়ে দেখছিলাম। একবার তো বলেই ফেললাম- দেখো তোমার জন্য সোনাই বাঁধানো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করবো! সে তো হেসেই খুন! সত্যি বলতে কষ্ট লাগলেও- তার হাসি অবশ্য অত সুন্দর না। কিন্তু তার গায়ের গন্ধে এক অদ্ভুদ কার্তিকীয় নেশা ছিল। যাকে আমি ‘কাতি জ্যার‌্যা’ নেশা বলতাম। তা শুনে সে এমন হাসি দিত যার কাপুনিতে এই গ্রহ-নক্ষত্র মন্ডলী সব কিয়ামত আসন্ন হয়ে পড়তো। কতবার বলেছি- তোমার গায়ের গন্ধের জন্য আমি আবার মানবের শুরুতেও যেতে রাজি! হায় ঈশ্বর! আমার কাতি জ্যারা নেশা।

যদিও এটা গালি এবং এই ‘কাতি জ্যারা’ শব্দটা আমার প্রয়াত এক দাদার কাছে থেকে ধার করা! ঈদানীংকালে শব্দটাকে আমার মত করে নিয়েছি কিন্তু এই শব্দটার একটা চমৎকার ব্যাখ্যা আছে। বাংলা কার্তিক মাসে দেখবেন রাস্তার কুকুর গুলো আমাদের ফুলসজ্জ্বা রাতের মতন লাজ-লজ্জ্বা ভুলে আদিম সুখে মেতে ওঠে। একে তো অন্যের কুকুরকে ধরে যা ইচ্ছা তাই করে, তার উপর মানুষের মত লজ্জাশীল, পর্দাশীলদের সামনে। ধরেন, বাবা-মা’র সাথে পার্কের হাওয়া গায়ে মাখতে গেলেন, ঐ সময় দেখলেন আপনাদের সামনেই রাসলীলা! তো আমার সেই প্রয়াত দাদাকে যখন অতিষ্ট করতাম তখন সে ‘কাতি জ্যারা’ বলে গালি দিত! সেটাই আমার জীবনে এসে এক সময় নেশার, ভালবাসার আর অবশ্যই সুমহান বিচ্ছেদময় ক্লান্তিহীন দীর্ঘশ্বাসের নাম হয়ে গেল। হাহ..........

আমরা গোরস্থানে প্রেমলীলা করতে করতে গভীর থেকে আরও গভীরে চলে এলাম। গাইছিলাম একইসাথে-
‘‘পাপীদের কেউ ভালবাসেনি
পাপীদের কেউ কাছে ডাকেনি
তবু এই ক্ষত-বিক্ষত অবিশ্বাসে
তুমি আমি মিশে পুনর্জন্ম সঙ্গী’’

আদমের প্রবেশদ্বার শেষ করে হঠাৎই চলে এলাম নরকের সার্বজনীন অপ্রিয় অন্ধকার জগতের ময়দানে। আমাদের চারিপাশে অতীতের পোড়খাওয়া মানুষের সারি, এপিটাফের জীবিত শব্দ, স্যাঁতস্যাতে মাটির গন্ধ, পাখিদের সেই পরিচিত শব্দ আর ঘন জঙ্গলের মাঝে জানা-অজানা জীব। বৃষ্টির কারণে কবর গুলোতে পানি জমে বিশ্রী অবস্থা। পৃথিবীর সমস্ত বৃষ্টি যেন এখানেই হয়েছে। বৃষ্টির জলে কবর থেকে মাথা, হাড়গোড়, চুল আর কাপড়ের টুকরাগুলো বেরিয়ে পড়েছে। হাটতে গিয়ে এসব মাড়িয়ে চলতে হচ্ছে। এসব পবিত্র জিনিসে পা মাড়াতেও বুক কাঁপছে। এজন্যই বলছিলাম- গোরস্থানে মানুষ প্রবেশ উচিৎ নয়। বুকের ভিতর তিনবার ভয়তাড়ানি থুথু দিয়ে বললাম- ঈশ্বর! বন্যা হয় এমন জায়গায় পরকালের জন্য আমাদের বিক্রি করনা! সাথে আরও আছে চোরা গর্তের অনাকাঙ্খিত ভয়। তবুও সবকিছু আপন আর বন্ধুত্বপূর্ণ যেন। জীবনের কোলে কিছু অশ্লীলতা পাওয়ার মতই। নির্জীব শুষ্কতা ছাপিয়ে ভেতরের সব আবর্জনা গুলো বেরিয়ে শূণ্যতার প্রতি আসক্তি হয়ে পড়ছে। এই ভাললাগা যেন কত গত পনর্জন্মের তা হয়তো কোন ফেরেস্তাও হিসাব করতে পারবে না।

এত কিছুর মাঝেও দুপুরের পর খিদে আর গরম দুটোই উৎশৃঙ্খল হয়ে উঠল। খাবার সঙ্গে আনা হয়নি। সঙ্গে শুধু জল, তাও ফুরিয়ে আসছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও কোন খাবার পেলাম না। আবার হতাশায় ডুবতেও পারলাম না এই ভেবে যে- গোরস্থানে খাবার থাকে না। গোরস্থানে থাকে সারি সারি লাশ আর অনন্তকালের নিস্তব্ধতার নীরবতা। প্রকৃতি যে এত নিঝুম বিষণ্ণ হতে পারে তা হয়তো এখানে না এলে কখনো জানা হতো না। আরও কিছুক্ষণ হাটার পর আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। সে আশ্চর্য হয়েছিল কি? সম্ভবত না। দেখলাম একটা বাড়ি! পুরনো হলেও মোটামোটিভাবে টিকে আছে। শেওলা আর আগাছায় বাড়িটার অস্তিত্ব প্রায় সেখানকার লাশের মত নিঃচিহ্ন। আমি প্রথমে ঢুকতে চাইলাম না। কিন্তু আমার নিকৃষ্ট দেবী তা হতে দিল না। বলল- চলনা ঢুকে দেখি। দারুন মজা হবে! মনে মনে ভাবলাম, বিশাক্ত সব বন্ধুর প্রিয় স্বর্গে মহাবিশ্বের আবেদনময়ী মজার কি দেখলো? শেষমেশ ঢুকতে বাধ্য হলাম। যুবতীর কথা তো আর এত সহজে ফেলা দেওয়া যায় না, আবার যদি সে হয় গায়ে পড়া জেদী। জীবনে কখনো ভূত-প্রেত, নরপিশাচ, রাক্ষস, ডাইনি এসবে ভয় ছিল না। আর সাপ এড়ানোর কৌশলও রপ্ত ছিল পাকাপোক্তভাবে। কিন্তু অতীতের এত সাহস সব উবে গেল পলকের ভিতরে। বাড়িটার ভেতরে ঢুকেই বুঝলাম বাড়ি বলতে যা বোঝায় এটা তা না। এটা একটা লাশ ধোওয়া ঘর! তার উপর দুনিয়ার যত্তসব পোকামাকড় আর সাপদের বিশ্রামাগার। ভয়ার্ত বিষণ্ণ আর দুঃখে ভরা। যেন এক দুঃখের প্রাসাদ, জাহান্নামের প্রাক-সংরক্ষণ! কাল-নাগিনী সাপের মত উড়–ক্কু মন ঘরের সবকিছু আবিষ্কার করতে চাইলো। আবার প্রবোধ দিল- মরতে চাও, ভাগো!

সাধারণত লাশ ধোওয়া বা জানাজা ঘর একতলা হয় কিন্তু এটা দুতলা। ঘরের নিচতলার বামপাশে লাশ ধোওয়ার জন্য কাঠের খাটলি আর পানি রাখার জন্য একটা গোলাকার ট্যাংক করা আছে। খাটলির নিচে উকি দিতেই দেখলাম একটা মাথার খুলি হে..হে..হে করে হাসছে আমার নারকীয় সঙ্গির মতো! ঘরটা কবরের মতোই অন্ধকার। ছোট ছোট দুটি জানালা আর দরজা দিয়ে একমাত্র আলো চলাচলের রাস্তা। সাথে সাথে ভেবে রাখলাম- আমাদের প্রত্যেকের কবরে দুটো করে জানালা আর একটা দরজা রাখবো। মৃত বলে কি আলো-বাতাসের দরকার হবে না? ধুলো-আবর্জনা ছাড়া আর তেমন কিছু দেখলাম না। আমি বেরিয়ে আসার ভাবনার আগেই দেখি- উনি উপরের সিড়ি দিয়ে দিব্যি হেঁটে হেঁটে পথ দেখিয়ে চলেছেন ডাইনি বুড়ির মতো। সেই প্রথম তাকে অন্য ভাবে আবিষ্কার করার চেষ্টায় মত্ত হলাম। কিন্তু পরক্ষনে তা ভুলে তার পিছুপিছু হাঁটা শুরু করলাম। দ্বিতীয় তলায় পৌঁছে দুজনেই খুব অবাক হলাম। ঘরটা কিছুটা পরিষ্কার, গোছানো, আর তাতে মানুষের থাকার জন্য চমৎকার পালঙ্গ! পশ্চিমের জানালাটা খোলা, মৃতদের নির্মল বাতাস আসছে সেখান দিয়ে। ভাবলাম এটা মনে হয় মৃত সর্দারের থাকার জায়গা। দুজনেই বেশ আগ্রহ নিয়ে নতুন স্বাদের খোঁজে নতুন কিছু খুঁজতে থাকলাম। আমি বললাম- এখানে এমন একটা জায়গা ভাবা যায়? ও অমনি বলে উঠল- এখানে আজ রাত থাকলে কেমন হয়? তা শুনে তার সবথেকে সুন্দর অংশটি কেটে ওলিভওয়েলে ভেজে কচমচিয়ে খেতে ইচ্ছে হল। একে খিদা লেগেছে, দুই দিনের শেষ ভাগ! দিনের আলো থাকতে থাকতেই এখান থেকে বেরুনো উচিৎ। নয়তো হৃদয়বান সাপের কামড়ে এখানেই প্রাচীন সবার সাথে শুতে হবে। আবার দেখা যাচ্ছে মৃতদের সর্দার বিশেষ পূর্ণিমা রাত বলে কোন বেশ্যাকে বলিদান দিতে নিয়ে এসে দেখে তার জায়গায় আমরা। আহা! দৃশ্যটা কল্পনা করতেই আনন্দ হচ্ছে। একবার পশ্চিমের জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কার্তিকের শেষ বিকেল তখন। জানালায় দাঁড়িয়ে বৈচিত্রময় অতীতের কথা গুলো ভাবছিলাম। বিশুদ্ধ শূণ্যতায় কিভাবে বড় হলাম, কিভাবে নিজেকে খুঁজে পেলাম অসীমতার ভীড়ে, বিশ্বস্ত দুঃখ আর হতাশা ভুলে সুন্দর জীবন পেলাম। এত কিছুর মূলে ছিল আমার প্রাণপ্রিয় শত্রুটা! স্নিগ্ধ হাওয়ার সাথে গোরস্থানের গন্ধ দুটো মিলে আমার সঙ্গিনীর গায়ের গন্ধের মত মাতকতা জাগিয়ে তুলছিল। হাওয়ার ষ্পর্শে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছিল সারা গায়ে। অযাচিত কিছু শিহরণ আর কামনার টানে যখন আমি পিছন ফিরে ওর দিকে তাকালাম দেখলাম সে বদলে গেছে। মুখ ভয়ংকর এবং ভয়ার্ত হয়ে পড়েছে। বিস্ময় জাগার মত চোখ গুলো বড় হয়ে গেছে। কেন? এসব যখন ভাবছি সে ততক্ষনে আমি কিছু বুঝে না ওঠার আগেই কাঠের একটা টুকরা নিয়ে তেড়ে আসছে। আমি ততক্ষনাৎ তাকে আটকাবার চেষ্টা করলাম এবং ব্যর্থ হলাম। প্রচন্ড জোরে আমার মাথার উপরের দিকে আঘাত করলো সে। আমি তলার দিকে মাথা নিচু করলাম। ঠিক তেত্রিশ সেকেন্ড পরে বুঝলাম আমার মাথায় আঘাতটা লাগেনি। তখন উপরের দিকে তাকাতেই দেখি আমার সহৃদয়া, অন্যন্যা, পরকালের বাহাত্তর হুরের একমাত্র শত্রু একটা রুসেল ভাইপার হাতে নিয়ে হিহিহি করে হাসছে! তখন মনে হল- উঠে গলাটা চেপে ধরে মেরে ফেলি! এটাই একমাত্র ঘটনা নয়, সে এই প্রথম এরকম দূর্ঘটনা থেকে আমায় বাঁচালো। বলতে আনন্দ নেই, বিশাক্ত বিচ্ছুটা প্রতিনিয়ত আমাকে বাঁচিয়ে আসছে সেই মহাবিশ্বের শুরু থেকে। আমার মহাবিশ্ব! যখন আমি শূণ্য তখন আমাকে তার সবটা দিয়ে পরিপূর্ণ করেছে। যখন আমি দুঃখের প্রাসাদের মত আবর্জনায় ডুবন্ত পরকাল যাত্রী তখন নগ্ন হয়ে সাতরে আমাকে উদ্ধার করেছে। এই হচ্ছে সে, যাকে ছাড়া ঠিক আমাকে কল্পনা করতে পারবেন না। এরকম একটা ঘটনা ঘটার পর কে এই দুঃখের প্রাসাদে থাকতে চাইবে? আমি ফিরে যাওয়ার কথা বলতেই বলল- না...... আমি যাবো না। এখানেই সারাজীবনের জন্য থাকবো! এই অগণিত লাশের সাথে ঘুমাবো! কি আর করা আগেই বলেছি সে প্রচন্ড জেদী মাগি। অন্তত একটা রাত তো থাকা লাগবেই। দমকা হাওয়ায় ঘরের আগাছা-লতাগুল্ম গুলো নড়াচড়া করছে। তাদেরই নড়াচড়ায় নীরব নগরে প্রাণের শব্দ আনন্দোসব করছে। ফুর্তি করছে মৃত বেশ্যাদের সাথে! কার্তিক মাসের বিকেলের ঘরে ফেরা পাখি গুলো ফিরতে শুরু করছে এরই মধ্যে। পাখিগুলোর মতো সেও আমার বুকে এসে ঠাঁই নিল। জড়িয়ে ধরে বলল- দেখ ঐযে জানালায় রক্তলাল সূর্যটা কিভাবে আমাদের মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তোমাকে মৃত্যুর মতই ভালবাসি। জানিনা সে এরকম বলে কেন? এরকম উদ্ভট কথাবার্তাও নতুন নয়, আমি অভ্যস্থ। ওকে বুকে জড়িয়ে মাথায় আদর করতে থাকলাম। ‘কাতি জ্যারা’ নেশাটা তখন চেপে ধরলো। হঠাৎ এতটা তীব্র, এতটা আকৃষ্ট নেশা ওর প্রতি কখনো এর আগে হয়নি। বাইরের লাশের গন্ধ আর তার শরীরের গন্ধে আমি পাগল হয়ে উঠলাম আদিম নেশায়! আমার শেষ মনে আছে তখন আমি তার সম্পূর্ণ বুক নগ্ন করে ফেলেছি ধর্ষকের মত। এবং ধুলো জমা বিছানায় তাকে নিয়ে তার সদ্য স্ফুটিত বুকের উপরেই ঝাপিয়ে পড়েছি কার্তিক মাসের কুকুর গুলোর মত। ঐ সময় বিকেকহীন কুকুর আর আমার মধ্যে সয়ং সৃষ্টিকর্তাও পার্থক্য করতে খেয় হারিয়ে ফেলবেন! তাকে হাশরের মাঠের মত নগ্ন করে আদিম খেলার নেশাটা ক্রমাগত চাপ দিতে শুরু করেছি। এসব সে সবসময় আনন্দ আর পরিতৃপ্তির সহিত নিয়ে আসছে। জানিনা সেদিন দুজনে কতটা সময় পর মুক্ত হতে পেরেছিলাম? যখন আমার ‘কাতি জ্যারা’ নেশাটা আসতে আসতে শেষ হয়ে আসল- একটা উন্মক্ত গরম হাওয়া গায়ে এসে লাগল। আমি ক্লান্তিতে তার নগ্ন বুকে আমার মাথা রাখলাম। সেখানে সুখ না পেয়ে তার কানের কাছে। আবার তার বুকে মাথা রাখলাম। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম আমি ঠান্ডা কিছুর উপর শুয়ে আছি। বুক থেকে মাথা তুলে তার ঠোঁটে চুমু খেলাম। মনে মনে বললাম- তুমিই আমার মহাবিশ্বের ঈশ্বরী! তার শান্ত চুলগুলোই হাত বুলাতে বুলাতে বললাম- দেখ রক্তলাল সূর্যটা এখন ডুবতে বসেছে। কার্তিকের এই শেষ বিকেলটা আমাদের চমৎকার কাটল তাই না বলো? এই বলে তার হাতটা চেপে ধরলাম এবং বুকে তৃতীয়বারের মত মাথা রাখলাম। ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম আমার অস্তিত্ব ঐ রক্তলাল সূর্যের মত শেষ হতে চলেছে! যেভাবে শেষ হয়ে যায় একটি ভ্রুণ মৃত্যুর পথে হাটলে। গাছের শিকড় কেটে গেলে। সম্পর্কে বিশ্বস্ত অবিশ্বাস জন্মালে। বুঝলাম তার হৃদস্পন্দন কাজ করছে না। দেহ শীতল হয়ে গেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। শরীর জমে শক্ত হতে শুরু করছে। আমার অসম্ভব প্রিয় জরায়ু দিয়ে পদ্মার স্রোতের মত রক্ত গুলো ধুলোজমা চাদরে গড়িয়ে পড়ছে। পাগলের মত তাকে বারবার ঝাকালাম, চিৎকার করলাম, বিলাপ করলাম কিছুতেই সে আর ফিরল না। তার অসাড় নগ্ন দেহটা চোখ দুটো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল হাসি মুখে! নারকীয় দুঃখগুলো পরকালের দায়িত্ব ভুলে নেশাগ্রস্ত কার্তিকের শেষ বিকেলে এই দুঃখের প্রাসাদে এসে ক্লান্ত হয়ে আর ফিরতে চাইল না! তখন এই স্বর্গীয় প্রকৃতিতে ঘেরা নারকীয় গোরস্থানের প্রতিটি জীব, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি মৃত মানুষ প্রার্থনায় বসল পবিত্র শয়তানের উদ্দেশ্যে- বহু যুগের একাকীত্ব কাটিয়ে আজ তারা তাদের প্রাণপ্রিয় প্রাণহীন বন্ধু পেয়েছে!

এই কথা গুলো যখন লিখা শেষ হল, তখন আমি সেই দুঃখের প্রাসাদে আমার বামপাজরের হাড় দিয়ে বানানো স্যুপে শেষ এক চুমুক দিলাম। এখন আমি ৬৯ বছর ১১ মাস ২৯ দিন ২৩ ঘন্টা ১৭ মিনিটের একজন জীবিত মানুষ! সেকেন্ডের হিসাবটা আপনারা করে নিবেন। রক্তমাখা বিছানায় আমার স্ত্রীর সাথে একটু ঘুমনো দরকার। নেশাগ্রস্ত কার্তিকের সেই অমৃত রক্তপাতের বিকেল থেকে ভীষনই ক্লান্ত! 





পরবর্তী গল্প-
আমার ক্ষত-বিক্ষত বিশ্বস্ত অবিশ্বাসীরা

সকালের ঘুম ভেঙে জীবনের প্রথম যে মানুষটির অন্তেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিয়ে খুব যত্ন করে মাটি তুলে তার মৃত বুকের উপর প্রশান্তির যাত্রা শুভ হোক বলেছিলাম, সে আজ বিচ্ছন্ন হাওয়ার হারিয়ে গেছে এমন ভাবে যে, তাকে কল্পনা করতে কষ্ট হয়। ভাবতে ঘোলাটে লাগে কে ছিল সে? যাকে এই প্রাগৈতহাসিক যুগের বিশ্বাস শুকানো মরুভুমির মাঝেও খুঁজে বেড়াই অসীম বিরুদ্ধতার সাথে। ছেলেবেলায় অবিশ্বাস ছিল যে, মায়ের স্তন ছাড়া আর কারও স্তনে মুখ লাগানো যাবে না। কিন্তু সেই অবিশ্বাস ভেঙেছে বিয়ের ঠিক সাড়ে সতের ঘন্টা পরেই। অবিশ্বাস্য! কৈশরে রাস্তার ধারে বসে বিকেলের রোদ গায়ে মেখে যখন গিটারের তারে আঙ্গুল কেটেছি তখন বিশ্বাস এসেছে- রক্ত হয় লাল! কান্না হয় চোখের জল! এভাবেই যখন আরও একটু বড় হলাম পেয়ে গেলাম মখমলের ফুলপ্যান্ট। তার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বুঝতাম না- লজ্জা কাকে বলে?  এরকম হাজারো অবিশ্বাস এই দীর্ঘ জীবনে  এসেছিল যা ক্রমশঃ সময়ের পথে চলতে গিয়ে বিশ্বাস্ততা পেয়েছে। সেই ভোরের মত- যখন আমি  তার মৃত্যুকে অবিশ্বাস থেকে বিশ্বাসে পরিণত করেছিলাম!..................................

Tuesday, January 31, 2017

বিষণ্ণ পৃথিবী

তুমি তো দেখনি বিষণ্ণ পৃথিবী
আরব সমুদ্রে পাথরের ডুব
তুমি তো দেখনি প্রশান্তির হাহাকার
আমরণ নিশ্বাসে নিঃসঙ্গ সুখ!

তুমি তো দেখনি রাতের গন্ধ
নিভে নিভে জ্বলে জাগে
দেখনি তো মহাশূন্য আলো হয়ে
নাচে একাকী সূর্যের অন্ধকারে!

তুমি তো দেখনি মুমূর্ষু কাঁপুনি
অসম বিচ্ছেদের বিলাসিতা
তুমি তো দেখনি প্রিয় মৃত্যু
নির্জীব বুকে ঘুমন্ত প্রেমিকা!